আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বিডিনিউজ ১০ ডটকম: রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আরেকটি প্রস্তাব পাস হয়েছে।
শুক্রবার সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এবং প্রত্যাবাসনের পর তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ইইউ ও ওআইসির যৌথভাবে আনীত প্রস্তাবটি উন্মুক্ত ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়। ১৪২-২৬ ভোটে প্রস্তাবটি পাস হয়।
চীন, রাশিয়া ও কম্বোডিয়াসহ ১০টি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ২৬টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসির পক্ষে বাংলাদেশ এবং ইউরোপের জোট ইইউর পক্ষে অস্ট্রিয়া যৌথভাবে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করে। ওআইসি ও ইইউর সব সদস্য রাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মেক্সিকোসহ ১০৩ দেশ প্রস্তাবটি কো-স্পন্সর করে। প্রস্তাবটি ভোটে যাওয়ার আগে এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে ওআইসির পক্ষে তুরস্কের প্রতিনিধি ও ইইউর পক্ষে অস্ট্রিয়ার প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। তুরস্ক ও অস্ট্রিয়ার বক্তব্য সমর্থন করে প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদানের আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও বাংলাদেশ। ভোটগ্রহণের আগে ও পরে দেয়া বক্তব্যে প্রায় সব সদস্য দেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেয়ায় বাংলাদেশের অবদানের কথা উল্লেখ করে। অপরদিকে প্রস্তাবে মিয়ানমারের নিন্দার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার পথ তৈরি করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বার্থে প্রস্তাবকে সমর্থন করতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়া প্রসঙ্গে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, মিয়ানমারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে এবং মিয়ানমারের ছাড়পত্র অনুযায়ী কিছু রোহিঙ্গা পরিবার ও সদস্যদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন কাজ আমরা শুরু করতে সম্মত হয়েছিলাম। কিন্তু তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আশ্বাসের প্রতি কোনোভাবেই আস্থা রাখতে পারেনি এবং একটি পরিবারও মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে সম্মত হয়নি।
নাগরিকত্বের পূর্ণ নিশ্চয়তা, নিজভূমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিপূরণ দান, সহিংসতা থেকে সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পূর্ণ নিশ্চয়তা ছাড়া মিয়ানমারে তারা ফিরে যাবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। অতএব রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরির নিশ্চয়তার জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। মিয়ানমারে বিদেশিদের বাধাহীন প্রবেশের সুযোগ করে দিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের নীতিগত অবস্থানের কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আবারও মনে করিয়ে দেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের রাখা বা জোর করে ফেরত পাঠানো- এর কোনোটিতেই একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ নেই।
প্রস্তাবে ওআইসির পক্ষে বক্তব্যে জাতিসংঘে তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধি ফরিদুন সিনিরলিগ্লু বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নানা কৌশলে নির্যাতিত হয়ে আসছে। ২০১৭ সালে তাদের ওপর অভিযান ছিল ওই কৌশলেরই একটি ধাপ। সবাই মিলে সমন্বিত একটি কৌশল প্রণয়ন করতে না পারলে এ সংকটের সমাধান অসম্ভব বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, ওআইসি মনে করে, রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে, আর তাদের ওপর নিপীড়নকারীদের শাস্তি না হলেও এটা অসম্ভব।
গত বছরও সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ওআইসির আহ্বানে উন্মুক্ত ভোটের মাধ্যমে একই বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে সাধারণ পরিষদের প্লেনারিতে এটি পুনরায় পাস হয়। সে সময় তৃতীয় কমিটির এ প্রস্তাবে ১৩৫টি দেশ পক্ষে, ১০টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয় এবং ২৬টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। গত বছর সাধারণ পরিষদ গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী মিয়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গত বছরের চেয়েও বেশি ভোটে এবারের প্রস্তাব পাস- মিয়ানমারের বিপক্ষে বিশ্ব জনমতের অধিকতর জোরাল অবস্থানেরই সুস্পষ্ট প্রতিফলন। তৃতীয় কমিটিতে গৃহীত এ প্রস্তাব আগামী ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদের প্লেনারিতে উপস্থাপিত হবে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে চলমান মিয়ানমার সংকটের সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধানে এ প্রস্তাব তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরাল প্রত্যাশা।